গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়্না (চীনের প্রাচীর)

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়্না।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়্না বা চীনের প্রাচীর হল এক সুবিশাল মনুষ্য-সৃষ্ট প্রাচীর, যেটি ইঁট, পাথর, কাঠ ও অন্যান্য পদার্থ দিয়ে নির্মিত। চীনের বিশাল প্রাচীরটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণকারীদের দূরে রাখা এবং সামরিক অনুপ্রবেশকারীদের আটকানো। এখন এটি চীনবাসীদের নিকট শ্রদ্ধাস্বরূপ, যাঁরা এই প্রাচীরটির নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। এই প্রাচীরটি (পূর্বদিকের) হেবেই প্রদেশের শানহাইগুয়ান থেকে (পশ্চিমদিকে) গানসু প্রদেশের জিয়াউগুয়ান প্রদেশ পর্যন্ত চলে গেছে। এটি প্রাচীর, অস্ত্রাগার, সৈন্যনিবাস, আস্তাবল, প্রাচীরের ওপর আশ্রয়স্থল, দূরবীক্ষণ স্তম্ভ, ঘোড়ার গমনপথ, দূর্গ এবং গিরিপথের সমন্বয়ে গঠিত।

সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সঠিক যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক টাওয়ার বা স্তম্ভ, প্রাচীর বরাবর উঁচু স্থানে বা পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করা হয়েছিল। যদি কেউ অলক্ষ্যে গুপ্তভাবে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে সেইজন্য তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য কাঠের দরজাগুলিকে গুপ্ত ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করা হত।
তিনটি রাজবংশ; যেমন কিউইন্, হান্ এবং মিং-এর সময় বিভিন্ন জীবিকার মানুষজন এই বিশাল প্রাচীরটির নির্মাণে যুক্ত ছিল। এই স্থানটির সবচেয়ে সু-সংরক্ষণ ও সংস্করণ প্রাচীন মিং রাজবংশের সময়েই হয়েছিল।

1987 সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়্না্ বা চীনের বিশাল প্রাচীরের উপর দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা নিতে, সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এই অঞ্চল পরিদর্শনে আসে। এটিকে এখন আমরা যেভাবে দেখছি, সেই একই আশ্চর্য্যের সাথে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও উপলব্ধি করতে পারে সেই কারণে এই স্থানটিকে খুবই সুরক্ষিত করা হয়েছে। এই সুবিশাল প্রাচীরটির পুনঃসংস্কারের ফলে এটির পরিদর্শনের সুবিধা আরোও প্রশস্ত হয়ে উঠেছে, তথাপি নিরাপত্তার অসুবিধার কারণে এই অঞ্চলের মধ্যে পদব্রজে গমন এখনও বিপজ্জনক।

এই বিশাল প্রাচীরটি বরাবর অনেক দূরবীক্ষণ স্তম্ভ বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে, যেগুলি এক-আধ কিলোমিটার বা কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর অবস্থিত। দূরবীক্ষণ স্তম্ভ বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলি দুই তলা লম্বা। এই প্রাচীর বরাবর 10,000-টিরও বেশি দূরবীক্ষণ স্তম্ভ বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এবং সাংকেতিক (আলোক সঙ্কেত দেওয়ার নিমিত্ত) টাওয়ার রয়েছে।

প্রাচীরটির বর্তমান অবস্থা নিম্নলিখিত কারণে গুরুতর বিবেচনার দাবী রাখে:

  • প্রাচীরের উপর চিত্রিত দেওয়াল অঙ্কনগুলি, প্রাচীরের সৌন্দর্য্য নষ্ট করছে।
  • কিছু গ্রামবাসী তাদের বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রাচীর থেকে পাথর বের করে নিয়ে ব্যবহার করছে।
  • ধূলিঝড় থেকে ক্ষয়কার্যে গানসু-র নিকট প্রাচীরের অন্তর্ধান হয়েছে।
  • দ্য গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না শুধুমাত্র চীনের অন্তর্গতই নয়, বরঞ্চ সারা বিশ্বের কাছেই এটি এক মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র ন্যায় একটি প্রাচীরের নির্মাণ তখন ভীষণভাবে প্রয়োজন ছিল। সুতরাং চীন, অনুসন্ধানকারী ঝেং হে-র অভিযানমূলক সমুদ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল, যাতে চীনের বিশাল প্রাচীরটির নির্মাণে সেই নৌ তহবিলও ব্যবহার করা হয়। বহু মানুষের কাছে বিস্ময়ের বিষয় যে গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না-য় কতগুলি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ির সংখ্যা এখনো নথিভুক্ত করা যায় নি।

চীনের বিশাল প্রাচীরের ক্রিয়াকলাপ

এই সুবিশাল প্রাচীরে আপনার ভ্রমণের সময়, আপনি নিম্নলিখিত কার্যকলাপের যে কোনটিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন :

  • মিতিয়ান্যূ কেবল্ কার রাইড।
  • বিশাল প্রাচীরটির চারপাশে পদভ্রমণ।
  • সিমতাই-তে প্যারাগ্লাইডিং।
  • দ্য গ্রেট ওয়্যাল ম্যারাথন।
  • নান্ গিরিপথ ভ্রমণ।
  • মূতিয়ান্যূ-তে স্লেজগাড়ি ভ্রমণ।

এছাড়াও আপনি কেবল্ কারের মাধ্যমে প্রাচীরটির জিনশানলিঙ্গ বিভাগ বরাবর সর্বোচ্চ শীর্ষকেন্দ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও নিতে পারেন। নিকটবর্তী পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে ফরবিডেন্ সিটি (নিষিদ্ধ নগরী), টেম্পল অফ হেভেন্ (স্বর্গ মন্দির), সামার প্যালেস এবং ওল্ড সামার প্যালেস ইত্যাদি।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ সম্পর্কে তথ্যাবলী

  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্, 2007 সালে নতুন সপ্তম আশ্চর্য্য-এর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল।
  • অগ্নিদ্যূতি ব্যবহার করে একটি টাওয়ার থেকে আরেকটি টাওয়ারে বার্তা পাঠানো হত। একবার দ্যূতির উন্মোচন মানে 100 শত্রু সংখ্যাকে সূচিত করত, অন্যদিকে দু’বার দ্যূতির উন্মোচন 500 শত্রুর সংখ্যা সূচিত করত।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না নির্মাণের সময় দশলক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন এবং এটিকে "পৃথিবীর দীর্ঘতম কবরস্থান" হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
  • 2004 সালে প্রায় 4 কোটি 20 লক্ষ বিদেশী পর্যটক গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
  • চীনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নেতা এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম চেয়ারম্যান, মাও জেডং, তাঁর “মাউন্ট লিউপান”- নামক কবিতায় লিখেছিলেন যে – “যদি আমরা বিশাল প্রাচীরটিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হই, তবে আমরা মানুষই নই”।
  • মূতিয়ান্যূর কাছে সুবিশাল প্রাচীরটির এক পরিত্যক্ত অংশ রয়েছে।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ বা চীনের বিশাল প্রাচীর কোথায় অবস্থিত?

বিশাল প্রাচীরটি, চীনের গানসু প্রদেশ থেকে হেবেই প্রদেশ পর্যন্ত প্রসারিত রয়েছে। বেইজিং বিমানবন্দর থেকে গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-য় পৌঁছানোর জন্য বেশ কিছু বিকল্প রয়েছে।

  • সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হবে একটি গাড়ী ভাড়া করা।
  • বেইজিং-এ এক দারুণ বাস পরিবহন সংযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান; সুতরাং আপনি বাসের মাধ্যমে ভ্রমণের বিকল্পটিও বেছে নিতে পারেন।
  • অন্য আরেকটি বিকল্প হল এয়্যারপোর্ট এক্সপ্রেস ট্রেন, যা ডোঙ্গঝিমেন পর্যন্ত যাতায়াত করে। এখান থেকে আপনি 2-নং সাবওয়ে লাইন বা পাতাল রেল দ্বারা যীশুইটান্ স্টেশনে নেমে, ডেশেঙ্গমেন পর্যন্ত হেঁটে, 919-নং বাস ধরবেন যা বাডালিং গ্রেট ওয়্যাল-এ পৌঁছে দেবে।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ পরিভ্রমণের সেরা সময়

গ্রেট ওয়্যাল-এর প্রাকৃতিক দৃশ্য ঋতুর সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। বসন্তকালে, প্রাচীরটি গাছপালা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ওঠে, এইসময় গাছপালাগুলি সবুজ আকার ধারণ করে এবং সমস্ত কিছুই সতেজ দেখায়। এছাড়াও এটি বিপূল পর্যটক ও জমায়েত এড়াবার জন্যও উপযুক্ত সময়, তাদের মধ্যে সাধারণত গ্রীষ্মকাল ও শরৎকালে এখানে ঘুরতে আসার ঝোঁক দেখা যায়। প্রাচীরটির পরিপূর্ণ দৃশ্য পরিদর্শনের সেরা সময় হল শীতকাল, এইসময় প্রাচীর ও পর্বতগুলি তুষারাবৃত থাকে।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র সময়

  • গ্রীষ্মকালে সকাল 6.30-টা. থেকে সন্ধ্যা 7.00-টা. পর্যন্ত খোলা থাকে।
  • শীতকালে সকাল 7.00-টা. থেকে সন্ধ্যা 6.00-টা. পর্যন্ত খোলা থাকে।

টিকিট

প্রবেশ মূল্য হল সি.এন.ওয়াই 45 বা সি.এন.ওয়াই 40, সেটা বছরের কোন সময় তার উপর নির্ভর করছে। সেখানে কেবল্ কার বা পুলি (কপিকল)-র জন্য আলাদা ধার্যমূল্য রয়েছে।

গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র উপর আরোও তথ্য

  • স্পেস বা মহাকাশ থেকে গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ কি দেখা যায়?
    গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্, নিম্ন ভূ-পৃষ্ঠ কক্ষপথ (লো আর্থ অরবিট বা লিও) থেকে নিঁখুত অবস্থায় দেখা যায়। যে সমস্ত মানুষ মহাকাশ যান থেকে বিশাল প্রাচীরটি দেখছেন, সাধারণভাবে তাদের নিম্ন ভূ-পৃষ্ঠ কক্ষপথ বা লিও থেকে প্রাচীরটির পরিদর্শনের চেয়ে 8-গুণ বেশি চাক্ষুষ তীক্ষ্ণতার প্রয়োজন। এটি চাঁদ থেকে খুব একটা ভালো দৃশ্যমান নয়।
  • কে এবং কোন বছরে গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র নির্মাণ করেছিলেন?
    গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র নির্মাণ, কোনও একজন ব্যাক্তির কাজ নয়। এতে অনেক রাজবংশই সংকটাপন্ন ঝুঁকি নিয়েছিল। প্রাচীরটির নির্মাণের শুরুতে প্রাচীন পশ্চিমী ঝোউ রাজবংশের (771 খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পূর্ববর্তী যুগ) ছাপ রয়েছে। ঝোউ রাজবংশীয়রা এই প্রাচীরটির বিভিন্ন অংশের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। ঠিক একইভাবে, অন্যান্য রাজবংশও আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে কিছু প্রাচীর তৈরি করেন। প্রাচীরের অধিকাংশই মিং রাজবংশের আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। এর পরবর্তীকালে কিউইন্ রাজবংশ (221 থেকে 206 খ্রীষ্টপূর্বাব্দ)-এর দ্বারা নির্মাণের সংযোজনে সংযুক্ত হয়।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র দৈর্ঘ্য কত?
    চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যপূর্ণ রাজ্য প্রশাসন বা চায়না্’স স্টেট আ্যডমিনিস্ট্রেশন অফ কালচ্যারাল হেরিটেজ দ্বারা পরিচালিত একটি নিরীক্ষা অনুযায়ী, গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র পরিমাপ হল 21,196.18 কিলোমিটার (13,170.69 মাইল)।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ কি বিচ্ছিন্ন করেছে?
    এটি রাশিয়া ও চীন-কে বিচ্ছিন্ন করেছে।
  • কোন দেশ গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র সীমান্তে রয়েছে?
    মঙ্গোলিয়া এর সীমান্তে রয়েছে।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-কে ফরাসি ভাষায় কি বলে?
    ফরাসি ভাষায় এটিকে গ্র্যান্ডে মূরাইল্যে ডি চাইন বলে।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-র উপনাম কি?
    প্রাচীরটির উপনাম হল “দীর্ঘ কবরস্থান”, কারণ এটির নির্মাণ করতে গিয়ে বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ কোথায় গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে?
    সাংহাই গিরিপথে গিয়ে, গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ ম্যারাথন্ কখন হয়েছিল?
    শেষ ম্যারাথন্ 17-ই মে, 2014 সালে হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের 5.164 সিঁড়ি আরোহণ করার প্রয়োজন ছিল।
  • কিভাবে গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়?
    প্রাচীরের কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে এবং কিছু কিছু অংশ ঝড় বা বায়ুপ্রবাহের ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের দ্বারা তুষারপাতের দরুণ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-য় হেঁটে অতিক্রম করতে কত সময় নেয়?
    গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্-য় হেঁটে অতিক্রম করতে বেশ কিছু মাস সময় নেয়, তবে আপনার চলার গতি এবং ক্ষমতার উপর নির্ভর করছে।
  • গ্রেট ওয়্যাল অফ চায়না্ কে পরিচালনা করেন?
    প্রাচীরটি, চীনা সরকারের পর্যটন বিষয়ক সংগঠন (দ্য ট্যূরিস্ট আফেয়ার্স অরগ্যানাইজেশন্ অফ দ্য চাইনিজ গভর্নম্যান্ট) দ্বারা পরিচালিত হয়।


* সর্বশেষ সংযোজন : July 10, 2015

Published On: Friday, July 10th, 2015