কখনও কখনও ভারতের মহাসড়ক হিসাবেও অভিহিত সূয়েজ খাল হল ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার সংযোগ সূ্ত্র, যা ভূমধ্য সাগর এবং লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করেছে। একটি মনুষ্য-সৃষ্ট জলপথ, এই খাল বা ক্যানেলটি হল একটি চিত্তাকর্ষক প্রাকৌশলিক বা ইঞ্জিনিয়ারিং কার্যকলাপ, যা 1869 সালে তার সূচনার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথকে সুগম করেছে। এই খালটির নির্মাণকার্যে প্রায় $ 100 মিলিয়ন অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। এই একক-নির্দেশিত পথের খালটি দু’টি অতিবাহিত এলাকায় বৈশিষ্ট্যগত রয়েছে – বাল্লাহ বাই-পাস এবং গ্রেট বিটার লেক।
মিশরে, বহুদিন আগে নীল নদের সঙ্গে লোহিত সাগরের ও ভূমধ্য সাগরের সংযুক্তিকরণের ধারণায়, এটি নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম এই ধরনের প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তবে, তাঁদের ক্যানেলটি নীল নদের শাখা-নদীর মাধ্যমে দুটি সমুদ্রকে সংযু্ক্ত করেছে। অবশেষে নীল নদের জলের অপসারণ ও পলি জমার কারণে পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার পূর্বে, বিভিন্ন শাসকদের দ্বারা এই খালটি তার ইতিহাসে বিভিন্ন শাসকদের দ্বারা অনেকবার পরিত্যক্ত এবং পুনরায় চালু করা হয়েছিল।
সরাসরি দু’টি সমুদ্রকে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে, এই আধুনিক খাল নির্মাণের প্রথম প্রচেষ্টা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল। তিনি আশা করেছিলেন যে, একটি খাল বা ক্যানেল নির্মাণের দ্বারা তিনি ব্যবসা ও বাণিজ্যের ওপর ইংরেজদের একাধিপত্য অধিকারের উপর এটি বিধ্বংসী আঘাত হানতে সক্ষম হবেন। তবে, তার ইঞ্জিনীয়াদের ভুল অনুমান ও চিন্তাধারায়, দুই সমুদ্রের মাঝখানে প্রায় 30 ফুটের একটি পার্থক্য থেকে গিয়েছিল। এর অর্থ স্বরুপ প্রকল্পটি পরিত্যক্ত করা হয়, যা পরবর্তীকালে যে কোনও কার্যকরী খালগুলি বন্ধ করা জরুরী ছিল, যা প্রকল্পটিকে খুবই ব্যয়বহুল করে তোলে। পরবর্তীকালে এটি নির্ধারিত করা হয় যে, দু’টি সমুদ্রের মাঝখানে উচ্চতায় কোন ব্যবহারিক পার্থক্য নেই এবং একটি খাল নির্মাণ সম্ভবপর ছিল।
1854 খ্রীষ্টাব্দে, ফার্ডিন্যান্ড ডি লেস্যেপস, মিশরীয় ভাইসরয় সঈদ পাশাকে প্রত্যয়িত করতে সক্ষম হন এবং 1858 খ্রীষ্টাব্দে, তিনি সূয়েজ খাল সংস্থা বা সূয়েজ ক্যানেল কোম্পানি সৃষ্টি করেন। এটি ক্যানেল তৈরি করার ক্ষমতা এবং পরিচালনার অধিকারী ছিল, যা 99 বছর পর, তার মালিকানাধীন মিশরকে স্থানান্তরিত করা হবে।
ক্যানেল বা খালটির নির্মাণকার্য 1859 খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে শুরু হয় এবং 1869 খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সম্পূর্ণ হয়। বছরের পর বছর ধরে, কোম্পানির মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ একাধিক সরকারগুলির মধ্যে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য ক্যানেলটির সম্ভাব্য অপব্যবহারের ওপর প্রচন্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। 1888 খ্রষ্টাব্দে, কনস্টান্টিনোপল কনভেনশন বা দেশাচার অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, জলপথ বা নাব্য খালটি পুরোপুরি নিরপেক্ষ হবে এবং যে কোনও রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে তাদের উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে নির্বিশেষে জলযানের পথ প্রস্তাবায়িত করতে হবে।
1952 সালে মিশরীয় বিপ্লবের পর, ক্যানেলটি সম্পূর্ণভাবে মিশর দ্বারা চালিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। 1956 সালে, ইজরায়েল, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন খাল বা ক্যানেলটির উপর পশ্চিমী নিয়ন্ত্রণ পুনুরুদ্ধার করার তাগিদে মিশরের উপর একটি আক্রমণের জন্য প্রবৃত্ত হয় এবং মিশরীয় রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসেরকে সম্পূর্ণ রূপে বিপর্যস্ত করেন। এটিই সূয়েজ সংকট বা ত্রিদলীয় আগ্রাসন হিসাবে পরিচিত ছিল। মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টির পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাষ্ট্রপুঞ্জের তিনটি আক্রমণকারী দেশই তাদের আক্রমণ প্রত্যাহার করে নেন। ক্যানেলটি বর্তমানে সূয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ (সূয়েজ ক্যানেল অথরিটি) দ্বারা পরিচালনার দায়িত্ব ও মালিকানাধীন রয়েছে, যা মিশরের মালিকানাধীন।
ক্যানেলটি নির্মাণের পূর্বে, পণ্যসম্ভার জাহাজ ইউরোপ থেকে এশিয়ায় যাত্রা করার সময় আফ্রিকার দক্ষিণী প্রান্তের চারপাশে ভ্রমণ করেন বা পণ্য-সামগ্রী ভূখন্ডের মাধ্যমে পরিবাহিত করা হয়। নৌপথ বা জলপথটি মিশর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু এটি একটি আন্তর্জাতিক চু্ক্তির অধীনে রয়েছে, সুতরাং এর ব্যবহার ভাগ করা রয়েছে। এই ক্যানেলটিতে, পানামা ক্যানেলের চেয়ে বেশি ট্রাফিক ও বৃহত্তম জাহাজের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। এটি নাটকীয়ভাবে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী রুটকে সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে পরিবহনের সময়কে হ্রাস করেছে।
আরবীয় ভাষায় এই খালটিকে কানাত আস-সূয়েজ নামে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এক অন্যতম জাহাজ পরিবহনের গতিপথ হয়ে ওঠা ক্যানেলটি বিশ্বের সবচেয়ে এক অপরিহার্য জলপথে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রজল এই জলকপাট মুক্ত অতিবাহিত পথ বেয়ে অবাধে প্রবাহিত হয়।
খাল বা ক্যানেলটিকে নিরাপদ করে তুলতে ক্যানেলের তীরগুলিকে অনবরত জাহাজ পরিবহনের দরুণ ধোওয়া ও তরঙ্গের প্রতিকূলতা থেকে প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিবন্ধক বেড়ির সঙ্গে অলম্বন করা হয়েছে। জাহাজগুলি ভূমিক্ষয় প্রতিরোধের জন্য খালটির মধ্যে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। ক্যানেলটি পরিদর্শনের নিখুঁত উপায় হল নৌকা বা ক্রুজ।
মিশর 2015 সালের 6-ই আগস্ট নতুন সূয়েজ খালের উদ্বোধন করে। একটি নতুন 37 কিলোমিটারের নৌপথ বা জলপথের সঙ্গে সম্প্রসারিত খালটির নামকরণ করা হয় “সূয়েজ খাল অক্ষ” (“সূয়েজ খাল আ্যক্সিস”)। সাম্প্রতিক সম্প্রসারণ ক্যানেলটির ধারণক্ষমতা দ্বিগুণ করে তুলেছে, জাহাজের সংখ্যা 49-টি থেকে 97-টিতে বৃদ্ধি হয়েছে।
ক্যানেলটি মিশরে অবস্থিত, এটি সূয়েজ-এর পোর্ট সঈদ থেকে পোর্ট তৌফিক পর্যন্ত সম্প্রসারিত। যেহেতু ক্যানেলটি প্রায় 200 কিলোমিটার দীর্ঘ তাই এটি পর্যটকদের দ্বারা ভ্রমণ করা হয়ে ওঠে না এবং পথ বরাবর বিভিন্ন কেন্দ্র দেখা যেতে পারে। অন্যথা, আরোও একটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার জন্য ক্রুজ নিয়ে ক্যানেল-এ ভ্রমণ করতে পারেন। তা নাহলে, ক্যানেলটির একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি পরিদর্শনের জন্য একটি ভাল জায়গা হল পোর্ট সঈদ-এর ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ বা মৈত্রী সেতু (বা মিশরীয়-জাপানি ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ)।
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি শীতের মাসগুলি হল সূয়েজ ক্যানেল পরিদর্শনের আদর্শ সময়। এই সময় আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে শীতল থাকে।
দ্য ওয়্যাটারফ্রন্ট কোয়ার্টার (নদী সরোবর আবাসন), মিলিটারি মিউজিয়াম, ডি লেস্যেপস’ হাউস, ইসমাইলিয়া মিউজিয়াম, সূয়েজ ক্যানেল হাউস, লেক টিমশা এবং স্টেলেই-এর বাগান হল ক্যানেলের চারপাশে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান।
অন্যান্য নিকটবর্তী আকর্ষণ : কায়রো, গিজার গ্রেট পিরামিড এবং আলেকজান্দ্রিয়া।
* সর্বশেষ সংযোজন : December 17, 2015