নৈনিতাল, উত্তরাখন্ড

নৈনিতাল ভারতের সবচেয়ে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ

নৈনিতাল, ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের একটি খুবই জনপ্রিয় শৈল শহর। “ভারতের হ্রদ জেলা” হিসাবে গণ্য নৈনিতাল, তার সরল শান্ত ও মনোরম সৌন্দর্য এবং হ্রদের জন্য বিখ্যাত। রাশকিন্ বন্ড, জিম করবেট ও ব্রিটিশ অভিনেতা এরিক মাটুরিন-এর ন্যায় কিংবদন্তিমূলক ব্যাক্তিদের সংযোগসূ্ত্রে নৈনিতাল প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এক স্বপ্নের গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে।

নৈনিতালের আকর্ষণ

নৈনি লেক : নৈনিতাল লেক নামেও সুপরিচিত, এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। লেকটির উত্তর প্রান্ত মল্লিতাল নামে অভিহিত, অন্যদিকে এর দক্ষিণ প্রান্তটির নাম দেওয়া হয়েছে তাল্লিতাল। লেকের মধ্যে নৌকাচালনা হল এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্যক্রম। আপনি এখানে প্যাডেল-বোট, র্যো -বোট বা য়্যাচট্ ভাড়া নিতে পারেন এবং পরিপূর্ণরূপে লেকটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এছাড়াও পর্যটকরা হ্রদের চারপাশে একটি ব্যস্ততাহীন পদচারণার আনন্দও নিতে পারেন।

মল্ রোড : মল রোড, লেক বা হ্রদটির উত্তর প্রান্তকে তার দক্ষিণ প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কিছু মাসের জন্য, রাস্তায় সব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে, ফলে রাস্তার সমগ্র প্রসারণ জুড়ে হাঁটা এবং ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ করে তোলে। মল রোড শৌখিন দ্রব্যের দোকান, রেস্তোঁরা, হোটেল এবং আরো অনেক কিছুর সঙ্গে আবৃত রয়েছে।

নয়না দেবী মন্দির : মন্দিরটি মা নয়না দেবীকে উৎসর্গীকৃত, যিনি দুটি নয়নের দ্বারা প্রতিস্থাপিত। এটি একটি ধসে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর নয়না দেবী মন্দিরটিকে পুনর্নির্মিত করা হয়। এটি লেকের উত্তর প্রান্ত বরাবর অবস্থিত এবং তার ইতিহাস ও প্রস্তাবিত সুন্দর দৃশ্যের জন্য পর্যটক ও উপাসকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

নৈনিতাল চিড়িয়াখানা : চিড়িয়াখানাটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2,100 মিটার (6890 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। উত্তরাখণ্ডের পার্বত্য অঞ্চলের বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্য নিয়ে 1984 সালে এই চিড়িয়াখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে 50-টিরও বেশী প্রজাতির মুক্ত পরিসর পাখি বিদ্যমান রয়েছে; যেমন – বাবলার, টিট, ম্যাগপি, জেয়, বারবেট, কাঠঠোকরা, থ্রাশে, কালিজ ফিজেন্ট, পাহাড়ি তিতির, হিমালয়ান গ্রীফন ও লাম্যেরজিয়ার শকুনি ইত্যাদি। পাখি পরিদর্শকের জন্য একটি স্বর্গোদ্যান ছাড়াও এটি বহু জীবজন্তুর আবাসস্থল। এখানে চিতাবাঘ, রোজ রিং টিয়া ও পার্বত্য শিয়াল, তিব্বতি নেকড়ে, সাম্বার, চিতা বিড়াল, হিমালয়ের ভালুক এবং আরোও অনেক কিছুর থাকাটাও কঠিন কিছু নয়। চিড়িয়াখানাটি অমসৃণ ভূ-খণ্ড জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে এবং এটির দেখার জন্য অনেকটা আরোহণ প্রয়োজন। দর্শকদের আরামপ্রদ জুতো পরতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

স্নো ভিউ পয়েন্ট : এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2270 মিটার (7448 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত এবং এটি ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ নন্দা দেবী সহ পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের এক মনোরম দৃশ্য পরিদর্শনের প্রস্তাব দেয়। যদিও সেখানে মোটরপোযোগী সড়ক হতে স্নো ভিউ পয়েন্ট যাওয়া যায়, তবে এরিয়্যেল রোপওয়ে দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই কেবেল কার স্নো ভিউ পয়েন্টকে নৈনিতালের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, যা তার নিজস্ব সত্ত্বায় এক পর্যটন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।

রাজ ভবন : উত্তরাখন্ড গর্ভনরের আধিকারিক বাসভবনটিতে ইউরোপীয় স্থাপত্যের কমনীয়তা ঝরে পড়ছে। এই ঊনবিংশ শতকের ভবনটি গথিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী, প্রায় 205 একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এছাড়াও এখানে একটি সুইমং পুল, একটি বিশাল বাগান ও সেইসঙ্গে একটি গল্ফ ক্ষেত্রও রয়েছে। এটি ইতিহাসে আগ্রহী দর্শকদের জন্য নৈনিতালেরএকটি অবশ্য-দর্শনীয় স্থান।

নয়না শৃঙ্গ : চাইনা শৃঙ্গ বা চীনা শৃঙ্গ নামেও পরিচিত নয়না শৃঙ্গ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2,615 মিটার (8579 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত এবং এটি শহরের সর্বোচ্চ কেন্দ্র। শৃঙ্গটি সমগ্র এলাকার অত্যাশ্চর্য দৃশ্য পরিদর্শনের প্রস্তাব দেয়। শৃঙ্গটিতে পৌঁছাতে, আপনাকে 6 কিলোমিটার হাঁটতে হবে অথবা মল্লিতাল বা স্নো ভিউ পয়েন্ট থেকে কোনও টাট্টু ঘোড়ায় আরোহণ করে পৌঁছাতে হবে।

টিফিন টপ্ : এই জনপ্রিয় পিকনিক স্থলটি, 2,292 মিটার (7519 ফুট) উচ্চ আয়ারপট্টা পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এখানে, ইংরেজ চিত্রশিল্পী, ডরোথী কেল্যীর এক স্মারক হিসাবে আপনি ডরোথী-র উপবেশনটিও দেখতে পেতে পারেন –এক বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর এটি তাঁর স্বামী ও প্রশংসকেরা এটির নির্মাণ করেছিলেন।

জিম করবেট জাতীয় উদ্যান : 1936 সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি দেশের প্রাচীনতম জাতীয় উদ্যান। এটি সুবিশাল করবেট ব্যাঘ্র সংরক্ষণের একটি অংশ। উদ্যানটির অভ্যন্তরে, যে কেউ অসংখ্য পশুদের দেখতে পাবেন; যেমন হাতি, চিতল, বাদূড় ও বাঘ এবং পাশাপাশি কিছু বিরল প্রজাতির প্রাণী যেমন ভোঁদড় ও মৎস্যভূক কুমীর। জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে পাহাড়, জলাভূমি বিশিষ্ট প্রাকৃতিক অবনমন, নদীতীরস্থ অঞ্চল, তৃণভূমি ও একটি সুবৃহৎ হ্রদ রয়েছে। যেহেতু এটি 650-টিরও বেশি প্রজাতির বাসিন্দা ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল, পক্ষী পরিদর্শককারীদের কাছে এই উদ্যানটি হল স্বর্গভূমি।

ভীমতাল : নৈনিতাল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভীমতাল, প্রাচীন মহাভারতের যুগে এর বর্ণনা রয়েছে। এর ইতিহাস থেকে সরে এসেও, ভীমতালের জনপ্রিয়তা তার হ্রদের মধ্যে আচ্ছাদিত রয়েছে। ছোটাছুটি ও শশব্যস্ততা এড়াতে ইচ্ছুক পর্যটকদের কাছে এই স্থানটি ভীষণ প্রলু্ব্ধময় স্থান।

সাততাল : সাত তাল নামেও পরিচিত স্থানটি তার সাতটি পারস্পরিক হ্রদের জন্য সুবিখ্যাত। এই স্থানের সমৃ্দ্ধ উদ্ভিদ এবং প্রানিজগৎ, ইকো-পর্যটক (পরিবেশ সচেতন পর্যটক)-দের কাছে এটিকে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছে।

নৈনিতালে বাসস্থানোপযোগী ব্যবস্থা

অশোক হোটেল ও অনামিকা হোটেল হল নৈনিতালের অসাধারণ বাজেট মূল্যে থাকার জায়গা। মাঝারি-মানের থাকার জায়গা অন্বেষণকারী পর্যটকরা ট্র্যাভেলার’স প্যারাডাইস নৌকূচিয়াতাল এবং বিক্রম ভিনটেজ্ ইন্-এ গিয়ে উঠতে পারেন। উচ্চাভিলাষী পর্যটকেরা শেরবাণী হিলটপ এবং আরিফ ক্লাসিক হোটেলে গিয়ে দেখতে পারেন।

নৈনিতালে খাবারের সংস্থান

কিংবদন্তিমূলক ভাপা মোমো এবং অন্যান্য তিব্বতীয় খাবার যদি আপনার ক্ষিদেকে উসকানি দেয়, তবে মল্লিতালের সাকলেয়-র রেস্তোঁরাতে সোজা এগিয়ে যান বা বড় বাজারের শিবায় গিয়ে সেরা কিছু মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখুন। একচেটিয়া পাঞ্জাবি রান্নার খাবারের জন্য সবকিছু ছাড়িয়ে শের-ঈ-পাঞ্জাবে এগিয়ে যান।

নৈনিতাল মানচিত্র

নৈনিতাল সম্পর্কে তথ্যাবলী

  • যেহেতু অঞ্চলটি হ্রদ দ্বারা কেন্দ্রীভূত, তাই কখনও কখনও এটিকে ভারতের হ্রদ জেলা বলেও অভিহিত করা হয়।
  • নৈনিতাল একটি গ্রীষ্মকালীন পশ্চাদপসরণ হিসাবে একজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, ভগবান শিব, দেবী সতীকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় দেবী সতীর নয়নযুগল এখানে ভূপতিত হয় এবং সেই থেকে এটি নৈনিতাল নাম ধারণ করে।

নৈনিতাল কোথায় অবস্থিত?

নৈনিতাল, ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নৈনিতাল জেলায় অবস্থিত।

পৌঁছানোর উপায়

বিমান মাধ্যমে

পন্তনগর বিমানবন্দর, নৈনিতাল থেকে প্রায় 57 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সেখান থেকে নৈনিতাল পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগে।

রেল মাধ্যমে

প্রায় 23 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাঠগোদাম রেলওয়ে স্টেশন হল নৈনিতালের নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন। গাড়ির মাধ্যমে স্টেশনে পৌঁছাতে এক ঘন্টারও কম সময় লাগে।

সড়ক মাধ্যমে

একটি সংহত সড়ক সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে নৈনিতাল নিকটবর্তী সমস্ত শহর ও নগরগুলির সাথে সু-সংযুক্ত রয়েছে। নৈনিতাল থেকে দিল্লীর ন্যায় নিকটবর্তী শহরগুলির মধ্যে রাজ্য-চালিত ও সেইসঙ্গে বেসরকারী বাসগুলিও চলাচল করে।

নৈনিতাল পরিদর্শনের সেরা সময়

মার্চ ও জুন মাস নৈনিতাল পরিদর্শনের সেরা সময় হিসাবে বিবেচিত হয়।

নৈনিতালের উপর আরোও তথ্য

  • নৈনিতালের উচ্চতা কি?
    নৈনিতাল, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2,084 মিটার (6837 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত।
  • দিল্লী থেকে নৈনিতাল কতদূরে অবস্থিত?
    দিল্লী ও নৈনিতালের মধ্যবর্তী দুরত্ব 300 কিলোমিটারের চেয়েও কম এবং গাড়ির মাধ্যমে পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘন্টার বেশী সময় লাগে।


* সর্বশেষ সংযোজন : August 14, 2015

Published On: Friday, August 14th, 2015