মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় স্ট্যানলি সেতু

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত স্ট্যানলী সেতু

331 খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডার দ্বারা প্রবর্তিত আলেকজান্দ্রিয়া, গ্রেইকো-রোমান মিশরের রাজধানী হয়ে উঠেছিল। আজকের দিনে, আলেকজান্দ্রিয়া “ভূমধ্য সাগরের মুক্তো” বা “দ্য পার্ল অফ মেডিটারেনিয়ান” নামে সুপরিচিত রয়েছে এবং এটি হল মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। একটি বাতাবরণের সঙ্গে এটি মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ভূমধ্যসাগরীয় হয়ে উঠেছে। এখানকার সাংস্কৃতিক বহু আকর্ষণ ও ধ্বংসাবশেষের প্রাচুর্য্যতা এই শহরটির পরিদর্শনকে সুন্দর করে তুলেছে যা তার মহিমান্বিত অতীতের প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এটি এমন একটি শহর, যা অবসর সময়ে যথেচ্ছভাবে অন্বেষণ করা যেতে পারে।

আলেকজান্দ্রিয়ার আকর্ষণ

ফোর্ট কৈৎব্যে : কৈৎব্যের দূর্গ হিসাবে পরিচিত দূর্গটি, এক অন্যতম প্রাচীন বিশ্বের সপ্ত আশ্চর্য্য – কিংবদন্তিমূলক ফারোস লাইটহাউসের প্রতিস্থাপণে, 1477 খ্রীষ্টাব্দে, মামলূক সূলতান আল-আশরাফ সঈফ আল-দীন কৈৎ ব্যে-র দ্বারা নির্মিত হয়। এটি নির্মাণ থেকে, ভেঙ্গে দুইবার পুর্ননির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটকরা এখনও খুবই নিকটস্থ সমুদ্রতলদেশের চারপাশে বাতিঘর বা লাইটহাউসের ধ্বংসাবশেষ সেই সঙ্গে দূর্গটির প্রাচীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ দেখতে পেতে পারেন; যেহেতু লাইট-হাউসের ভগ্নাবশেষ থেকে পতিত হওয়া উপাদানগুলি দূর্গটির বাইরের দিকের প্রাচীরের নির্মাণে পুর্নব্যবহার করা হয়েছিল। দূর্গটি খুবই চিত্তাকর্ষক এবং এর অভ্যন্তরে নাভাল বা নৌসম্বন্ধীয় মিউজিয়াম রয়েছে, যাতে রোমান এবং নেপোলিয়ানের সমুদ্র যুদ্ধ থেকে হস্তনির্মিত দ্রব্য ও চিত্র প্রদর্শিত রয়েছে।

বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়া : বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়া হল 400 খ্রীষ্টাব্দে ধ্বংসীভূত হওয়া আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাক্তন গ্রন্থাগারের স্থানে নতুনভাবে নির্মিত একটি গ্রন্থাগার। নতুন গ্রন্থাগারটি, হেলেনিসটিক থেকে রোমানিক এবং বাইজেন্টাইন থেকে ইসলামী যুগ পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়া ও ভূমধ্যীয় অঞ্চলের ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি জ্ঞানের ভান্ডার তৈরির হিসাবে প্রাচীন গ্রন্থাগারটির প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়। এটি একটি বৃত্তাকার চাকতির প্রতিসম হওয়ায় গ্রন্থাগারটির নকশা বেশ আকর্ষণীয়, যা আংশিক ভাবে মাটিতে সংস্থাপিত রয়েছে। কোর্নিচের একটু পূর্বদিকে অবস্থিত, এটি প্রাচীন বিশ্বের এক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার এবং গবেষণা পণ্ডিতদের জন্য একটি বিশিষ্ট গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়াও বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়ায় মধ্যে চারটি মিউজিয়াম রয়েছে – দ্য আ্যন্টিকিউটিস মিউজিয়াম (পুরাতাত্ত্বিক যাদুঘর), দ্য ম্যানাস্ক্রিপটস মিউজিয়াম (পাণ্ডুলিপি মিউজিয়াম), দ্য সাদাত মিউজিয়াম এবং দ্য হিস্ট্রি অফ সায়ন্স মিউজিয়াম; সেইসঙ্গে নয়টি পর্দার মাধ্যমে একটি প্ল্যানেটোরিয়াম, এক্সপ্লোরেটোরিয়াম, মিশরের ইতিহাসের উপর একটি সাংস্কৃতিক প্যানোরোমা বা পরিদৃশ্য প্রদর্শিত হয় এবং একটি মিথস্ক্রিয় অসৎ বাস্তবিক পরিবেশ, ভিস্তা প্রদর্শিত হয়।

গ্রেইকো-রোমান মিউজিয়াম : 1892 খ্রীষ্টাব্দে মাত্র 11-টি গ্যালারির সঙ্গে একটি ছোট মিউজিয়াম হিসাবে নির্মিত, 1895 খ্রীষ্টাব্দে এটিকে তার বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। গ্রেইকো-রোমান মিউজিয়াম বা যাদুঘরের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন দেশ এবং ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য থেকে তার ব্যাপক মুদ্রার সংগ্রহ। এইগুলির মধ্যে বেশ কিছু মূদ্রা খ্রীষ্টপূর্ব 630 শতকের প্রাচীন। এই মূদ্রাগুলি একটি কালানুক্রমিকভাবে সাজানো রয়েছে। এছাড়াও মিউজিয়ামটিতে শত-শত অতি মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রীও রয়েছে; যেমন অন্যান্য জিনিষের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যরূপে রয়েছে আ্যপিস বূল, দু’টি মস্তিষ্কবিহীন স্ফিংক্স (গ্রীক পুরাণে উল্লিখিত নারীর মুখ ও সিংহের দেহবিশিষ্ট ডানাওয়ালা দানব), মমি, সার্কোফাগি (ভাস্কর্য-শিল্প অলংকৃত শিলালিপি সমন্বিত প্রস্তর শবাধার)।

পম্পেই-এর স্তম্ভ : পম্পেই-এর স্তম্ভ হল একটি নিকষিত চাকচিক্যময় আসওয়ান গ্রানাইট স্তম্ভ, এটি সেরাপিস মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা বেষ্টিত, 27 মিটার উচ্চতার সঙ্গে দু’টি স্ফিংক্স মূর্তির পাশে উপস্থাপিত রয়েছে। পিলার বা স্তম্ভটি সম্রাট ডাইওক্লেতিয়ানের সম্মানে 297 খ্রীস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। সম্রাট ডাইওক্লেতিয়ান, জুলিয়াস সিজার-এর হাতে তাঁর পরাজয়ের পর তিনি মিশরে পালিয়ে যান। 48 খ্রীস্ট পূর্বাব্দে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল এবং কথিত রয়েছে যে তাঁর দেহাবশেষ এখানে সমাধিস্থ করা হয়। এই পিলারটি হল আলেকজান্দ্রিয়ার সমগ্র স্তম্ভগুলির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চতম প্রাচীণ মনুমেন্ট বা স্মৃতিস্তম্ভ।

কাম-ঈল-শূক্কাফা-য় অবস্থিত রোমান সমাধি : কাম-ঈল-শূক্কাফার ক্যাটাকোম্ব বা সমাধি হল বৃহত্তম রোমান কবরস্থান এবং এটি খ্রীস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রাচীন। 100 ফুটের একটি গভীর পাথর থেকে কাটা কবরস্থানটি ফারাওনিক ও রোমান শিল্পকলায় প্রতিনিধিত্বে তিনটি স্তরে নির্মিত রয়েছে। সমাধির অভ্যন্তরটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সুসজ্জিত এবং গ্রীক, মিশরীয় ও রোমান সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক সংমিশ্রণে বৈশিষ্ট্যযুক্ত রয়েছে। এগুলি খুবই সুন্দর ও বিস্ময়কর হওয়ায় মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কোর্নিচে : কোর্নিচে হল ক্যাসিনো, প্রাসাদ ও হোটেলের সঙ্গে সুসজ্জিত সৈকত-সম্মুখস্থিত একটি বীথিকা বা এভ্যিনিউ, এগুলি উচ্চ স্তম্ভে নির্মিত এবং সারিবদ্ধ সৈকত কুটীরের সঙ্গে লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। সারিবব্ধ জনপ্রিয় সৈকতগুলির মধ্যে রয়েছে মা’মূরা, সিডি বিশর, গ্লাইমোনোপোলৌ এবং ইব্রাহিমিয়া। সৈকতগুলির দরুণ, এটি পর্যটকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ও প্রাণবন্ত। জনসাধারণ অলসভাবে বা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়া্ছে, প্রাপ্তবয়স্করা আঁকশি দিয়ে মাছ ধরছে, তরুণ-তরুণীরা কফির সঙ্গে সঙ্গীত উপভোগ করছে, বয়স্করা ব্যাকগ্যামন (পাশা-দাবার ন্যায় ক্রীড়াবিশেষ) খেলছে, শিশুরা বিশাল নাগরদোলার উপর উড়নচন্ডীভাবে ঘুরছে এবং রোমাঞ্চকর ডাইভিং, এই সমস্ত কিছু কোর্নিচে-র ‌শ্রেষ্ঠ বর্ণনা দেয়।

হোটেল
সাশ্রয়ী ভ্রমণার্থীরা ফিলিপ হাউস হোটেল এবং অধম কম্পাউন্ড হোটেলে গিয়ে দেখতে পারেন। মারকার রোম্যান্স আলেকজান্দ্রিয়া এবং প্যারাডাইস ইন্ লে মেট্রোপোল হোটেল হল মধ্যবিত্ত-মানের ভ্রমণার্থীদের জন্য অসাধারণ বিকল্প। উচ্চাভিলাষী ভ্রমণার্থীরা ফোর সিসনস হোটেল আলেকজান্দ্রিয়া এবং হিলটন্ আলেকজান্দ্রিয়া কোর্নিচে-তে গিয়ে দেখতে পারেন।

আলেকজান্দ্রিয়ার মানচিত্র

আলেকজান্দ্রিয়া সম্পর্কে তথ্যাবলী

  • এটি কায়রোর পর মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজধানী।
  • এটি একসময় হেল্যেনস্টিক ও সেই সঙ্গে রোমান ও বাইজেন্টাইন মিশরের রাজধানী ছিল।
  • আলেকজান্দ্রিয়ার লাইটহাউসের ধ্বংসাবশেষগুলি 1994 সালে, ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়।

আলেকজান্দ্রিয়া কোথায় অবস্থিত?

কায়রো থেকে 225 কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দূরত্বে অবস্থিত, আলেকজান্দ্রিয়ার শহরটি মিশরের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত।

বিমান মাধ্যমে

আলেকজান্দ্রিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামেও পরিচিত, ই.আই নৌঝা বিমানবন্দরটি হল শহরের প্রধান বিমানবন্দর।
বোর্গ ই.আই আরব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হল শহরটির দ্বিতীয় বিমানবন্দর, যা এই শহরের মধ্যে পরিষেবা প্রদান করে। এটি শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং গাড়ির মাধ্যমে পৌঁছাতে এক ঘন্টার একটু কম সময় লাগে।

রেল মাধ্যমে

আলেকজান্দ্রিয়ায় দু’টি প্রধান রেলওয়ে স্টেশন হল মিশর এবং সিডি গাবের।

সড়ক মাধ্যমে

আলেকজান্দ্রিয়া, নিকটর্তী শহরগুলির সঙ্গে সুংযুক্ত রয়েছে। এখান বেশ কিছু বাস রয়েছে যেগুলি কায়রো থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্যে চলাচল করে।

আলেকজান্দ্রিয়া পরিদর্শনের সেরা সময়

বসন্ত ও শরৎকাল হল আলেকজান্দ্রিয়া পরিদর্শনের সেরা সময়। বসন্তকাল সাধারণত মার্চ ও জুনের মধ্যবর্তী সময়ে বিরাজ করে, অন্যদিকে শরৎকাল সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে স্থিত হয়।

আলেকজান্দ্রিয়া সম্পর্কিত আরোও তথ্য

মিশরে কি ধরনের জলবায়ু অনুভূত হয়?

মিশরের অন্যান্য শহরগুলির অসদৃশ, আলেকজান্দ্রিয়ায় মধ্যপন্থী ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অনুভূত হয়। শীতকালে, তাপমাত্রা সাধারণত 10° C (ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) থেকে 20° C (ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড)-এর মধ্যে থাকে; অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে, তাপমাত্রা 22° C (ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) থেকে 34° C (ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড)-এর মধ্যে থাকে।

আলেকজান্দ্রিয়ায় কি ধরনের পোশাক পরিধান করা উচিৎ?

মিশর হল একটি মুসলিম কেন্দ্রিক দেশ এবং সেইজন্য পর্যটকদের, বিশেষ করে মহিলাদের সংরক্ষণ-প্রবণ পোশাক পরিধান করা উচিৎ।

* সর্বশেষ সংযোজন : December 07, 2015

Published On: Monday, December 7th, 2015