হাওড়া ব্রিজ, কলকাতা

রাতের বেলায় আলোকিত হাওড়া ব্রিজ

কলকাতায় ব্রিটিশ স্থাপত্য কর্মের আরেকটি শক্তিশালী অনুস্মারক বা স্মৃতিচিহ্ন হল হুগলী নদী (কলকাতায় গঙ্গা নামে পরিচিত)-র প্রস্থ জুড়ে প্রসারিত হাওড়া ব্রিজ - ইস্পাতের একটি দৈত্যকার প্রসারণ যা দুটি যমজ শহর হাওড়া ও কলকাতা (সেই সময় ক্যালকাটা নামে সুপরিচিত ছিল)- কে সংযুক্ত করেছে।

তবে কলকাতার ঔপনিবেশিক স্থাপত্য থেকে আধ্যাত্মিক আলোড়ন, সমস্তকিছুর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার একটা অভ্যাস রয়ে গেছে এবং সেগুলিকে তার নিজস্ব এক স্বতন্ত্র স্পর্শে অলঙ্কৃত করে তুলেছে। আন্তরিকতা ও আত্মবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে কলকাতায় একক সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার অধীনে সমস্ত কিছুর উপস্থিতি ঝরে পড়ছে। এই মর্যাদা সমন্বিত কলকাতা, ভারতের রাজধানী থেকে মাওবাদী অধ্যূষিত শহরে রূপান্তরণ বহন করে চলেছে। এই কলকাতা তার প্রাণোচ্ছলতার হিসাবে এখনও তার “বাবুমশাই” সংস্কৃতিকে ঝেড়ে ফেলার এবং উন্নয়নের পদক্ষেপকে আলিঙ্গনের চেষ্টা করে চলেছে – কলকাতা সত্যই একটি খুবই আকর্ষণীয় আন্তর্জাতিক গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে।

একজন ভ্রমণার্থী, যদি কলকাতা ভ্রমণের মাধ্যমে শহরটিকে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করেন তবে হাওড়া ব্রীজটি অতিক্রম করার সময় অবশ্যম্ভাবীরূপে কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়বেন। তবে, কলকাতা নিউ ইয়র্ক নয় আর এখানে আপনি আপনার ব্যস্ততাহীন ব্রুকলিন ব্রীজে স্বস্তিতে ছবি তোলার কথা আশা করতে পারেন না। আপনি 705 মিটার দীর্ঘ ব্রীজটি হেঁটে চলার পরিকল্পনা করলে, বিশ্বের এই ব্যস্ততম সেতুটির উপর দিয়ে আপনার চলার পথে আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, যে এখানে থামার জন্য ও দেখার জন্য কেবল কয়েকটি মুহুর্তই পাবেন। এর চেয়ে এই স্থাপত্যকর বিস্ময়টি সম্পর্কে পূর্বেই জেনে নেওয়াটা একটি ভালো ধারণা।

হাওড়া ব্রিজের ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মিদের সম্মুখে মিত্র বাহিনীকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য বিট্রিশদের দ্বারা এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল। অনেক সূত্র দাবি করে যে, হাওড়া ব্রিজ ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। তারা আসলে, 1874 সালে স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি-র দ্বারা নির্মিত পন্টুন সেতুর কথা উল্লেখ করেছেন। হাওড়া ব্রিজটি দীর্ঘ সাত বছর ধরে কাজ চলার পর, 1942 সালে সম্পূর্ণ হয় এবং 1943 সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়।

হাওড়া ব্রিজের স্থাপত্য

ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সেতুগুলির মধ্যে হাওড়া ব্রিজ গণ্য হয়। এটি সেই সময়ের একটি স্থাপত্যের বিস্ময়। নির্মাণের সময়ে, এই সেতুটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম খিলানের উপর স্থাপিত সেতু ছিল। কখনও কেউ কলকাতায় ভ্রমণে গেলে, অবশ্যই হাওড়া ব্রিজ পরিদর্শনের একটি সফর নিশ্চিত করবেন; দেখে বিস্ময় বোধ করবেন যে ‘কোনওরকম নাট ও বোল্ট ছাড়াই’ 82 মিটার উচ্চতার সঙ্গে 705 মিটার দীর্ঘ জুড়ে, দৈনিক 150,000 যানবাহন ও 4,000,000 পথচারীদের ওজন বহন করে কিভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওড়া ব্রিজ হল একটি নিলম্বিত ধরনের সুষম খিলানের উপর স্থাপিত (ক্যান্টিলিভার) সেতু। এটির 1500 ফুট কেন্দ্রীয় ব্যাপ্তি রয়েছে। এটির নিলম্বিত বা ঝুলন্ত ব্যাপ্তি (স্প্যান) হল 564 ফুট।

হাওড়া ব্রিজের উপর ট্রাফিক

যে কোনও স্থাপত্যের কৃতিত্ব তার নকশা এবং শক্তির উপর বিচার করা হয়। এই উভয় ক্ষেত্রেই হাওড়া ব্রিজ উচ্চ সাফল্যাঙ্ক পায়। উল্লেখিত রূপে, সেতুটি ট্রাফিক, যানবাহন, পথচারী এবং এমনকি গবাদি পশুর এক বিশাল প্রবাহকে সামাল দেয়। পাকা রাস্তার দু’ধারে, উভয়দিকে 15-ফুট বিস্তৃত ফুটপাত রয়েছে, যেগুলি পথচারীদের ভিড়ে পূর্ণ থাকে। 1993 সালের আগে পর্যন্ত, এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রামও চলাচল করত।

হাওড়া ব্রিজে আধুনিক নিরাপত্তা বিধান

সেতুটির একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে সি.সি.টি.ভি. ক্যামেরা স্থাপণ করা হয়েছে।

হাওড়া ব্রিজের পুর্ননামকরণ

হাওড়া ব্রিজটি, বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে রবীন্দ্র সেতু নামকরণ করা হয়। তবে, প্রাত্যাহিক বাক্যালাপে সেতুটির হাওড়া ব্রিজ নামটিই উল্লেখ হয়ে আসছে।

হুগলী নদীকে অতিক্রান্ত আরোও অন্যান্য সেতু

হাওড়া ব্রিজ যদিও কলকাতার একটি প্রতীক, তবে এটি হুগলী নদীতে বিস্তৃত একমাত্র সেতু না। হুগলী নদীতে বিস্তৃত, কলকাতা ও হাওড়াকে সংযুক্তকারী দ্বিতীয় সেতুটি – এক অন্যতম রজ্জু স্থিত (ক্যাবেল-স্টেড) সেতু। 823 মিটার দীর্ঘ, বিদ্যাসাগর সেতু নামে অভিহিত এই টোল সেতুটি সহজেই ভারতের দীর্ঘতম রজ্জু স্থিত (ক্যাবেল-স্টেড) হিসাবে অবস্থিত রয়েছে এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আশিটি সেতুর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। হুগলী নদীর উপর দিয়ে বিস্তৃত আরোও অন্যান্য সেতুগুলির মধ্যে রয়েছে বিবেকানন্দ সেতু, নিবেদিতা সেতু, জুবিলি সেতু ও ঈশ্বর গুপ্ত সেতু। “ব্রিজ”-এর বাংলা শব্দ হল সেতু। এই সেতুগুলি কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলিকে সূচিত করে; যেমন – দক্ষিণেশ্বর মন্দির, জগন্নাথ ঘাট ইত্যাদি।

কলকাতার এক প্রতীক – হাওড়া ব্রিজ

হাওড়া ব্রিজ কলকাতার সঙ্গে সমার্থক হয়ে চলে আসছে। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই এই স্থানটিকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে, যাতে হাওড়া ব্রিজের একটি দৃশ্য একান্ত অনিবার্য। অনেক বিখ্যাত বলিউড (হিন্দি) চলচ্চিত্রে হাওড়া ব্রিজকে প্রদর্শিত করা হয়েছে। এমনকি, এই একই নামের একটি বিখ্যাত হিন্দি ছায়াছবি বা সিনেমাও রয়েছে। রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর “দ্য সিটি অফ ড্রেডফুল নাইট" বা “ভয়ঙ্কর রাত্রির শহর"-এ হাওড়া ব্রিজের উল্লেখযোগ্য উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যবশত, সেতুটি ভারতের সবচেয়ে এক অন্যতম জনবহুল ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠা শহরের সর্বনাশ ভোগ করছে। এই সেতুটির সৌন্দর্য্য শুধুমাত্র পানের পিক ও পাখির মলের দাগেই নষ্ট হয় নি, বরঞ্চ এটির যথেষ্ট ক্ষয়ও হয়েছে।

রাত্রিতে সেতুটির একটি সফরের যাওয়ার চেষ্টা করুন, দিনের বেলায় যদি যান, তাহলে আপনি কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা ও দাঁড়াবার মতো সময় পাবেন না। রাত্রিবেলার আলোকিত দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনাকে কলকাতার জাগরুতির দিকে ঠেলে দেবে। দিনের গোলমালের বিনিময়ে রাতের নীরব জাজ্জ্বল্যমান হুগলী ভিন্ন প্রকৃতির। সান্ধ্যকালীন বাতাস, দিনের স্বেদ ও নোংরার পরিশ্রান্ততা থেকে নিষ্কৃতি বা নিস্তারের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে। হাওড়া ব্রিজ-এ একটি সন্ধ্যাবেলা, ভ্রমণার্থীদের কাছে একটি মিলনস্থান স্বরূপ - সেদিন আপনি এই শহরটিকে আপনার নিজের শহর বলে দাবি করার সিদ্ধান্ত নেবেন।

হাওড়া ব্রিজ মানচিত্র

হাওড়া ব্রিজ সম্পর্কে তথ্যাবলী

এই বিস্ময়কর স্থাপত্যটির সম্পর্কে কিছু তথ্যাবলী -

  • হাওড়া ব্রিজটি একটি আট-লেন যুক্ত সেতু যেখানে বিপূল ট্রাফিক দেখা যায়।
  • এই সেতুটির নির্মাণে এক অবিশ্বাস্য পরিমাণ - 26,500 মেট্রিক টন্ ইস্পাত ব্যবহৃত হয়েছিল।
  • টাটা স্টিল, সেতুটির নির্মাণে প্রয়োজনীয় ইস্পাতের এক অন্যতম সরবরাহকারী ছিল।
  • প্রখর গ্রীষ্মের সময়, সমগ্র সেতুটি এক মিটারর মতন দৈর্ঘ্যে প্রসারিত হয়।
  • সেতুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, এমতাবস্থায় ছবি তোলার উপর বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে, দূর থেকে আপনি যত ইচ্ছে ছবি তুলতে পারেন। নদীতীর থেকে এই দৃশ্য বিশেষভাবে ভালো দেখায়। কিন্তু যদি আপনি স্থাপত্য সম্পর্কে বাস্তবিক প্রখর দৃষ্টান্ত দেখতে চান তবে, একটি ভাল ধারণা হল ছবি তোলা (ফটোগ্রাফি) ভুলে, প্রকৃতভাবে এই বিস্ময়টি সম্পর্কে কাছ থেকে লক্ষ্য করুন।
  • এটি বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম খিলান সেতু।

হাওড়া ব্রিজ কোথায় অবস্থিত

ঠিকানা : হাওড়া, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ - 711101.

হাওড়া ব্রিজ পৌঁছানোর উপায়

বিমান মাধ্যমে
নিকটবর্তী বিমানবন্দর হল কলকাতায় অবস্থিত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একটি গাড়ী যশোর রোড হয়ে আধ ঘন্টায়, হাওড়া ব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেবে।
রেল মাধ্যমে
আপনি যদি হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনে নামেন, বঙ্কিম সেতু দিয়ে হাঁটতে থাকুন এবং 15 মিনিটের মধ্যে আপনি এখানে পৌঁছে যাবেন। গাড়ির মাধ্যমে গেলে সেখানে পৌঁছাতে আরোও কম সময় লাগে।
আপনি যদি শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাওড়া ব্রিজে পৌঁছাতে চান, তাহলে গাড়ির মাধ্যমে ভায়া মহাত্মা গান্ধী রোড হয়ে এখানে পৌঁছাতে আপনার প্রায় 10 মিনিট সময় লাগবে।

হাওড়া ব্রিজ পরিদর্শনের সেরা সময়

কলকাতা ও তার সমগ্র আকর্ষণীয় স্থানগুলি শরৎকাল ও শীতকালে অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে পরিভ্রমণ করুন। মার্চের পর, তাপমাত্রার প্রখরতা বাড়তে থাকে এবং জুলাই-আগস্ট নাগাদ প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং সড়কগুলি জলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে; তাই এইসময় ভ্রমণ কম উপভোগ্য হয়।

হাওড়া ব্রিজ দর্শনের সময়

হাওড়া ব্রিজ, সারাদিন ধরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে, সেতুটিতে একটি দীর্ঘ নির্বিঘ্ন সফরের জন্য, হয় গভীর রাতে না হয় খুব সকালে পরিদর্শন করার চেষ্টা করুন। কলকাতা ভোরবেলায় একটি ভিন্ন সৌন্দর্য ধারণ করে। এই সময়ে হাওড়া ব্রিজ পরিদর্শন একটি মহান অভিজ্ঞতা হতে পারে।

হাওড়া ব্রিজ টিকিট

সেতুটির সমগ্র পরিসরে প্রবেশের জন্য দর্শকদের কোনও প্রবেশমূল্য লাগে না।

হাওড়া ব্রিজ সম্পর্কে আরোও তথ্য

হাওড়া ব্রিজ-এর স্থানাঙ্ক্য কি?
22.5853 ডিগ্রী উত্তর এবং 88.3469 ডিগ্রী পূর্ব।

নিকটবর্তী আকর্ষণ কি কি?

    • ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
    • শহীদ মিনার, কলকাতা।
    • সায়েন্স সিটি, কলকাতা।
    • অথিরাপিল্লি ফলস্।
    • নিক্কো পার্ক।
    • বিড়লা তারামন্ডল, ইত্যাদি।

* সর্বশেষ সংযোজন : July 14, 2015

Published On: Tuesday, July 14th, 2015