জামা মসজিদ, দিল্লী

জামা মসজিদ - পুরনো দিল্লীর প্রধান মসজিদ

দিল্লীর জামা মসজিদ, বিপূল সংখ্যক মসজিদের দেশ - ভারতের বৃহত্তম মসজিদ। এটি শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত স্থাপত্যের একটি সেরা নিদর্শন। মুঘল সম্রাট শাহজাহান, তাঁর চারুকলা ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সুবিখ্যাত ছিলেন। শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত অন্যান্য স্মৃতিসৌধগুলির মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, লাল কেল্লা, আগ্রা ফোর্টের মোতি মসজিদ, জাহাঙ্গিরের সমাধি, ঠাট্টায় তাঁর নিজস্ব শাহজাহান মসজিদ।

শাহজাহানের আমলে নির্মিত স্মৃতিসৌধগুলিকে সহজেই বলা যেতে পারে যে এগুলি তাদের চারুতা এবং বিজড়িত নকশা দ্বারা মুঘল স্থাপত্যের বাকি নির্মাণকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলতে পারে। জামা মসজিদ শাহজাহানের স্বতন্ত্র ছাপ বহন করে চলেছে।

জামা মসজিদ, এক সরলতা এবং যুক্তির সঙ্গে ধর্ম এবং সমাজের ধারণাকে সঙ্গী করে নিয়েছে যা তিন শতাব্দী পরেও ধারণ করে রয়েছে। এমনকি আজও, মসজিদটি স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের গবেষণার এক প্রাচীন বস্তু নয়, বরঞ্চ এটা মানুষের ক্রিয়াকলাপের একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্র।

সন্ধ্যাবেলায় মসজিদ পরিদর্শনকারী মানুষেরা সূর্যের বর্ণচ্ছটায় সুবর্ণ লাল রশ্মিতে সিক্ত প্রাঙ্গনের কাছে গিয়ে বসেন। মসজিদের ফাটলে এবং তার সিঁড়ি ও গম্বুজের উপরে শত শত পায়রার বসতি স্থাপন করার দৃশ্যও দেখা যায়। মসজিদে আগত কোনও এক ছুটন্ত শিশু বা উৎসাহী ভ্রমণার্থীরা ভক্ষনকারী পায়রার গুচ্ছতে গিয়ে ভয় দেখানো এবং পায়রাদের একসঙ্গে উড়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃ্শ্যও দেখা যেতে পারে। তারা এক সুন্দর দৃষ্টিগোচর দৃশ্য তৈরি করে। সন্ধ্যাবেলায় যখন মুয়েজ্জিন প্রার্থনার জন্য সকলকে আহ্বান জানান, তখন নিকটবর্তী বাজার থেকে মানুষজন এখানে এসে ঢলে পড়ে। এমন একটি মুহুর্তে, মসজিদটিকে তার স্মৃতিসৌধ হিসাবে পার্থক্য করা অসম্ভব; যার স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য পৃথক গবেষণার দাবি রাখে। স্মৃতিস্তম্ভ, উপাসক ও প্রার্থনা যা বাতাসে ভেসে বেড়ায় – এই সমস্ত কিছুই একটি সংলগ্ন জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।

জামা মসজিদে একসঙ্গে 25000 ভক্তমন্ডলীর জমায়েতের সুবন্দোবস্ত রয়েছে।

দিনেরবেলা মসজিদের সমৃদ্ধ স্থাপত্য নকশা অধ্যয়নের জন্য উপযুক্ত।

মসজিদটির নির্মাণ কার্য 1650 খ্রীষ্টাব্দে শুরু হয় এবং 1656 খ্রীষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হয়।

মসজিদটিতে, তার প্রাঙ্গনের তিনদিক থেকে উন্মুক্ত দ্বার রয়েছে – উত্তরীয় দ্বার, দক্ষিণী দ্বার ও পূর্বীয় দ্বার। পূর্বীয় দ্বারটিকে রাজকীয় দ্বার বলা হয়। প্রতিটি দ্বার বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মানুষের প্রবেশপথ চিহ্নিত করত। সম্রাট এবং তাঁর পরিবার পূর্বদিকের দ্বার দিয়ে ঢুকতেন যেটিতে 35-টি ধাপ রয়েছে। উচ্চবংশীয় বা উচ্চপদস্থরা উত্তরীয় দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেন। সাধারণ মানুষেরা দক্ষিণী দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেন।

পূর্ব দিকের দ্বারের ছাদটির উপর মৌচাকের ন্যায় খোদাইকার্য সহ খিলান নির্মিত। এছাড়াও পূর্ব দিকের দ্বারটি বেশ কিছু সংখ্যক ছোট ছোট সুদৃশ্য গম্বুজ দ্বারা সুসজ্জিত করা। দ্বারটির পিছন দিকে থেকে একটি বাঙ্গালী অলিন্দ অভিক্ষিপ্ত রয়েছে।

মসজিদটি পশ্চিম দিকে মুখ করে রয়েছে। দক্ষিণ ও উত্তরের দ্বারগুলি তুলনামূলকভাবে কম সুসজ্জিত শৈলীযুক্ত এবং আকৃতিতেও ছোট। এই দ্বারগুলির উভয়দিক থেকে আগত বারান্দায় সতেরোটি করে খাম্বা বা কলাম রয়েছে।

মসজিদের কেন্দ্রীয় ভবনটির প্রাঙ্গন বেলেপাথরে নির্মিত। সমস্ত দিক থেকে প্রাঙ্গনটির চারপাশে স্তম্ভশ্রেণীযুক্ত অলিন্দ বা বারান্দা আছে। প্রাঙ্গনটির কেন্দ্রে অভিষিঞ্চিত পুকুর রয়েছে। এটি মার্বেলের তৈরি এবং কেন্দ্র থেকে একটি ঝরনা ধারা ঝরে পড়ছে। ডানদিকে জলাধার বা ট্যাংকটির সামনে মুয়েজ্জিনের জন্য একটি বেলেপাথরের মঞ্চ আছে। মুয়েজ্জিন হলেন একজন ইসলামিক যাজক যিনি সান্ধ্যকালীন প্রার্থনায় তাদের বিশ্বাসী অনুসারীদের প্রার্থনায় অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। একটি ধূসর বেলেপাথরের যাজকসম্প্রদায়-মঞ্চ ও দুটি সময় নির্দেশক ঘড়ি, মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারে দেখা যেতে পারে। এটি তিনদিক দিকে প্রাচীর দ্বারা ঘেরা রয়েছে এবং একদিকে মসজিদটি রয়েছে।

প্রধান মসজিদ :
প্রধান মসজিদটিতে একটি খিলানপথের মাধ্যমে প্রবেশ করতে হয়। শীর্ষে গম্বুজ সমন্বিত খিলানপথের উভয় পাশেই মিনার রয়েছে। মসজিদ মহল থেকে পাঁচটি খিলান উন্মুক্ত রয়েছে।

স্থান পরিকল্পনা ও স্থাপত্য নকশার মধ্যে, জামা মসজিদের সঙ্গে আগ্রার মোতি মসজিদের প্রচন্ড মিল রয়েছে। কেন্দ্রীয় খিলানপথটির স্প্যানড্র্যালের(ত্রিকোণাকৃতি স্হানে) উপর “ইয়াহাদি” শব্দটি খোদাই করা রয়েছে।

প্রধান মসজিদটির মেঝেটি মোজাল্লার নকশা সহ সরু কালো মার্বেল দ্বারা নির্মিত, মোজাল্লা হল মুসলিমদের প্রার্থনার সময় ব্যবহৃত এক প্রকার কার্পেট বা মাদূর।

জামা মসজিদের ছাদের ওপর তিনটি গম্বুজ রয়েছে। এগুলির একটি বহিঃআবরণ ও আন্তঃআবরণ রয়েছে এবং এই আবরণের মাঝখানে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। এটি শুধুমাত্র মসজিদের একটি মহীয়ান চেহারাই দেয় না, বরঞ্চ শীতল রাখতেও সাহায্য করে। গম্বুজগুলি একেবারে শীর্ষে অবস্থিত এবং তামার স্বর্ণমন্ডিত সূচাগ্র সহ আরোহিত রয়েছে।

জামা মসজিদের ইতিহাস :
সম্রাট শাহজাহান দ্বারা, শাহজাহানাবাদের সুরক্ষিত শহরে একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তার জন্য জামা মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ করতে পাঁচ হাজার শ্রমিকদের টানা ছয় বছর সময় লেগেছিল, নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল 1650 খ্রীষ্টাব্দে। তৎকালীন শ্রমিকদের প্রতিদিন 1 পয়সা করে মজুরি দেওয়া হত! এই প্রকল্পটির জন্য দশলক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল, এমনকি এই মূল্যের মধ্যে পাথর এবং মার্বেলের মূল্য বিবেচনা করাই হয় নি।

জামা মসজিদ সম্পর্কে তথ্যাবলী

  • জামা মসজিদের বাস্তবিক নাম হল মসজিদ-ঈ জাহাঁ-নূমা। যদিও, আজকের দিনে খুব কম জনই এই স্মৃতিসৌধটির প্রকৃত নাম জানে।
  • মূল পরিকল্পনা এবং নকশা ওস্তাদ খালিল দ্বারা করা হয়েছিল।
  • মসজিদটিতে হরিণের চামড়ার উপর লিখিত কোরাণের একটি প্রতিলিপি এখানে দেখা যেতে পারে।

জামা মসজিদ কোথায় অবস্থিত?

জামা মসজিদ, প্রসিদ্ধ লাল কেল্লার খুবই সান্নিধ্যে, তার পশ্চিমে প্রায় 500 মিটার দূরে অবস্থিত। এটি ভো ঝালা পর্বতের সর্বোচ্চ কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঠিকানা : চাঁদনী চক্, নতুন দিল্লী।

দূরাভাষ (টেলিফোন নং) : 011-23365358.

বিমান মাধ্যমে : নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হল ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় বিমানবন্দর। এখান থেকে, কোনও একটি গাড়ীর মাধ্যমে, বন্দেমাতরম মার্গ হয়ে গেলে আপনার এক ঘন্টারও কম সময় লাগবে।

রেল মাধ্যমে : নতুন দিল্লী রেলওয়ে স্টেশন থেকে, কোনও এক গাড়ীর মাধ্যমে, ভায়া ডি.বি.গুপ্তা রোড হয়ে গেলে আপনার 18 মিনিট সময় লাগবে।

জামা মসজিদ পরিদর্শনের সেরা সময়

চরম শীতকালের একটু আগে বা একটু পরে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে পরিভ্রমণে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনি যদি মসজিদের প্রাঙ্গনের মধ্যে আপনার সময় উপভোগ করতে চান, তবে খুব মনোরম আবহাওয়া পাবেন। আপনি যদি শুধুমাত্র আবহাওয়ার অনুভূতি নিতে চান, তবে সন্ধ্যাবেলা হল শ্রেষ্ঠ সময়। তবে, আপনি যদি এই স্থানের স্থাপত্যের অন্বেষণে প্রবল উৎসাহী হন, তবে দিনের বেলায় ভ্রমণে আসার চেষ্টা করুন।

জামা মসজিদ টিকিট

মসজিদে প্রবেশের জন্য কোনও প্রবেশমূল্য লাগে না।
তবে নিম্নলিখিতরূপে অন্যান্য ধার্যমূল্য প্রযোজ্য রয়েছে:

  • জুতোর নিরাপত্তা বা জিম্মাদারির জন্য 10/- টাকা।
  • মিনারে প্রবেশের জন্য 10/- টাকা।
  • ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশের জন্য 200/- টাকা।

জামা মসজিদ দর্শনের সময়

মসজিদটি ভোরবেলা থেকে গোধূলি বেলা পর্যন্ত খোলা থাকে, তবে প্রার্থনার সময় এটি বন্ধ থাকে। ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ভ্রমণার্থীদের সংরক্ষণশীল পোশাকের পরামর্শ দেওয়া হয়।

জামা মসজিদের উপর আরোও তথ্য

জামা মসজিদের স্থানাঙ্ক্য কি?
28.6507 ডিগ্রী উত্তর, 77.2334 ডিগ্রী পূর্ব।

জামা মসজিদের কাছাকাছি আগ্রহের জায়গা কি কি?
মীনা বাজার, মৌলানা আজাদ সমাধি, গুরুদুয়ারা শীস্ গঞ্জ।

* সর্বশেষ সংযোজন : July 14, 2015

Published On: Tuesday, July 14th, 2015