একটি হাউসবোট (বাসযোগ্য বজরা)-এ ধীরেসুস্থে ভ্রমণ-যাত্রা, লক্ষ লক্ষ মনোমুগ্ধকারী টিউলিপ সমন্বিত একটি বাগিচায় পায়চারি (তাদের মাথা দোলানো প্রাণবন্ত নৃ্ত্য) এবং উচ্চতর উচ্চতায় হ্রদ বরাবর ট্রেকিং: অসাধারণ গন্তব্যস্থল হিসাবে কাশ্মীরকে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ আছে। জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং “প্রাচ্যের ভেনিস” হিসাবে পরিচিত, এটি তুষারপাতের সঙ্গে আপনাকে অবাক করে তুলতে পারে বা দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকার স্মৃতি বা বাতাসের সামান্য আঁচড় আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। এমনকি আপনি সম্পূর্ণরূপে তার প্রাকৃতিক দ্যুতি থেকে মুক্তি পাওয়ার আগেই, দেখবেন যে শত-শত বছরের প্রাচীন ইতিহাস আপনাকে এক অনিমেষনেত্রে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মসজিদ, মন্দির এবং সমাধি আপনাকে এক বিশ্ব সৌন্দর্য্যমুখর অভিজ্ঞতা প্রদান করবে।
“প্রাচ্যের ভেনিস” হিসাবে গণ্য শ্রীনগর হল ভারতের সুদূর উত্তর-প্রান্তীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। ঝিলাম নদীর তীর বরাবর অবস্থিত কাশ্মীর উপত্যকা - তার মুঘল উদ্যান, চিত্র অনুপম হ্রদ, টিউলিপ উৎসব, হাউসবোট (বাসযোগ্য বজরা), ঐতিহ্যপূর্ণ কাশ্মীরি হস্তনির্মিত দ্রব্য ও শুষ্ক ফলের জন্য পর্যটকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
শহরটি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর সময়কালে সম্রাট অশোকের দ্বারা নির্মিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের ইউনিয়নের একটি অংশ হয়ে ওঠে এবং 1947 সালে ভারতের স্বাধীনতার পর শ্রীনগর তার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হয়ে উঠেছিল।
ডাল লেক : ডাল লেক তার হাউসবোট, “শিকারা”-র জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পূ্র্ণবিকশিত পদ্মফুল ও নির্মলতার জন্য সুখ্যাত। 26 বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রসারিত, হ্রদ বা লেকটি চারটি ভাগে বিভক্ত রয়েছে, যার মধ্যে নাগিন লেক হল একটি অন্যতম। কায়াকিং থেকে সাঁতার এবং ক্যানোয়িং থেকে হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা সহ ডাল লেক গ্রীষ্মকালে প্রচুর চিত্তবিনোদনের সুযোগ প্রদান করে। শীতের সময়, হ্রদটি কখনও কখনও হিমায়িত থাকে।
নাগিন লেক : “আংটির মধ্যে মণি” হিসাবে উন্নীত নাগিন লেক, অনেকের দ্বারা ডাল লেকের এক বিচ্ছিন্ন অংশ রূপে বিবেচিত হয়, কিন্তু এটি আসলে একটি সংকীর্ণ কজওয়ে বা উঁচু বাঁধের দ্বারা সংযুক্ত আছে। পর্যটকরা সেখানে প্রচুর হাউসবোট পেয়ে যাবেন। হ্রদটি নিস্তব্ধতা এবং নির্মলতা উপলব্ধ করায়।
জামা মসজিদ : 1674 সালে নির্মিত জামা মসজিদ, শ্রীনগরের মসজিদগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম। চারটি কুন্ডলী, 370-টি স্তম্ভ ও প্রার্থনা সভার সমন্বয়ে গঠিত মসজিদটি ইন্দো-শারাসেনিক স্থাপত্যের এক নিদারুণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মসজিদটির প্রতিটি স্তম্ভ হিমালয়ের সেডার (দারূবৃক্ষবিশেষ) কান্ডের একক খন্ডের দ্বারা নির্মিত। মসজিদটি তার ইতিহাসের ধারায় বহুবার বিপর্যস্ত ও পুনরুদ্ধার হয়েছিল। এটি ফ্রাইডে মসজিদ বা শুক্রবার মসজিদ নামেও পরিচিত।
হজরৎবল মসজিদ : ডাল লেকের তীরে অবস্থিত, মসজিদটি সাদা মার্বেলের তৈরি। কাশ্মীরের এক বিরল ঐক্যবন্ধন এবং মুঘল শৈলীর স্থাপত্য, হজরৎবল মসজিদ দরগাহ শরিফ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। নবী মুহাম্মদের চুলের একটি সূত্রে - এই পবিত্র আধারটি একটি ধ্বংসাবশেষকে ধারণ করে আছে বলে মনে করা হয়।
শঙ্করাচার্য মন্দির : শঙ্করাচার্য পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, এই মন্দিরটি প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব 200 শতকে, সম্রাট অশোকের পুত্র জালুকা-র দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের ধারণা অনুযায়ী এটি একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল, যেটি আদি শঙ্করাচার্য, প্রভু শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত, হিন্দুদের পূজার্চনার জায়গা হিসাবে রূপান্তরিত করেন। পাহাড়ের চূড়া থেকে, দর্শকেরা শ্রীনগর এবং পীর পাঞ্জল পর্বতমালার তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর একটি সামগ্রিক দৃশ্য পরিদর্শন করতে পারেন।
শ্রী প্রতাপ সিং মিউজিয়াম : 1898 সালে প্রতিস্থাপিত, মিউজিয়ামটিতে উশকূরের একটি বৌদ্ধ স্থান থেকে সংগৃহীত, তৃতীয় শতকের অন্তর্গত কিছু বিরল পোড়ামাটির মূর্তি, হারওয়ান থেকে চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীর সময়কালীন বিভিন্ন ঢালাই পোড়ামাটির ফলক, লোকেশ্বরের একটি প্রাচীন পিতলের মূর্তি এবং গান্ধার স্থাপত্য শৈলীতে, পঞ্চম শতকের একটি বুদ্ধ চিত্র এখানে প্রদর্শিত রয়েছে। এছাড়াও যাদুঘরটিতে প্রাচীন মূদ্রা, সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র, পাণ্ডুলিপি, ক্ষুদ্র অঙ্কন, হাতিয়ার ও অস্ত্রসম্ভার, বস্ত্র, ভাস্কর্য এবং চামড়া, ঘাস ও কাঠের কারুকার্যময় দ্রব্য-সামগ্রীও রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন : ডাল লেকের নিকটে জাবারওয়ান পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত বাগিচাটি তার সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত, বার্ষিক টিউলিপ উৎসবের জন্য প্রসিদ্ধ। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম টিউলিপ গার্ডেন হয়ে ওঠা ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন 70-টিরও বেশি প্রজাতির বর্ণময় টিউলিপ সহ মোট প্রায় কুড়ি লক্ষ টিউলিপের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। তার সন্নিহিত অঞ্চলে আরোও বিভিন্ন উদ্যান আছে; যেমন – শালিমার গার্ডেন, নিশাত গার্ডেন, অছাবল বাগ, পরী মহল এবং চশমে শাহি গার্ডেন।
নিশাত বাগ : 1633 সালে, আবদূল হাসান আসফ খানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, এই বাগিচাটি শ্রীনগরে স্থাপিত সবচেয়ে এক অন্যতম দীর্ঘ মুঘল বাগিচা। আক্ষরিক অর্থে “আনন্দের বাগিচা” নামে উদ্ধৃত নিশাত বাগ, তার বৈচির্ত্রময় ফুলের উদারতা, 12-টি সুশোভিত চত্বর, প্রস্ফুটিত পুষ্পশয্যা ও প্রসাধিত সুরেলা ঝরনাধারা বাস্তবিকভাবেই আপনার হৃদয়কে প্রসন্ন করে তোলে। এই বাগিচাটি পরিদর্শনের পরিকল্পনা করার সময়, পর্যটকরা অবশ্যই মনে রাখবেন যে টিউলিপ বছরে কেবলমাত্র 15 দিনের জন্য প্রস্ফুটিত হয়, সুতরাং তাদেরকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি ক্ষণিক দীপ্তিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য সেই অনুসারে পরিকল্পনা করতে হবে।
দচিগাম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য : পর্বত দ্বারা বেষ্টিত এবং তৃণভূমি ও পাথুরে পর্বতগাত্রের সঙ্গে চিহ্নিত, অভয়ারণ্যটি প্রায় 141 বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। 1981 সালে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত, অভয়ারণ্যটি ব্যাপক বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের আশ্রয়স্থল, বিশেষত আ্যভিফৌনা প্রজাতি ও হাঙ্গুল বা কাশ্মিরি হরিণ। উদ্যানটিতে প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র প্রয়োজন।
আপনি প্রায় তিন’শ বছরর প্রাচীন মুসলিম মিটিং হল বা মুসলিম অধিবেশন সভগৃহটি – খানকাহ শাহ-ঈ-হামাদান, চমৎকার মুঘল বাগিচা, বাদশাহ সমাধি এবং ঊলার হ্রদ অবশ্যই পরিদর্শন করুন। ডাল লেক-এ শিকারা রাইড, আ্যসটোন মার্গে প্যারাগ্লাইডিং এবং আ্যলপাইন লেক বরাবর ট্রেকিং হল অত্যুৎসাহিত ক্রিয়াকলাপ।
শ্রীনগরে পর্যটকদের জন্য প্রচুর বাসস্থনোপযোগী থাকার জায়গার বিকল্প আছে। হোটেল সাদাফ ও হোটেল নিউ প্রিন্স ইন্, সুন্দর শালীন দামে চমৎকার রুম নিবেদন করে। যারা সম্পূর্ণ বিলাসিতার সঙ্গে তাদের থাকাটাকে উপভোগ করতে ইচ্ছুক, তারা তাজের দ্বারা ভিভান্ত ডাল ভিউ শ্রীনগর বা দ্য ললিত গ্র্যান্ড প্যালেস-এ গিয়ে দেখতে পারেন। তবে স্বাভাবিকভাবে, অধিকাংশ পর্যটকই তাদের থাকার জন্য একটি হাউসবোট বা বাসযোগ্য বজরা ভাড়া নিতেই বেশি পছন্দ করেন।
একদিকে যেমন কৃষ্ণ বৈষ্ণো ধাবা দারুণ নিরামিষ খাবার পরিবেশন করে, অন্যদিকে কিছু মুঘলীয় খাবারের স্বাদ নেওয়র জন্য অহদুস হল নিখুঁত জায়গা। এছাড়াও আপনি জি ইন্ বেকারী-তে বেশ কিছু সুস্বাদু প্যাস্ট্রি ও মটন ভুরিভোজও খেতে পারেন।
শ্রীনগর, সারা বছর ধরে মনোরম আবহাওয়ার সঙ্গে আশীর্বাদিত থাকে, সুতরাং পর্যটকেরা যে কোনও সময় শ্রীনগর পরিদর্শনে আসতে পারেন। তবে, এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলটিতে আবহাওয়া মনোরম থাকায় এবং সুন্দর ফুলে বিকশিত হয়ে ওঠায়, এই সময়টিই শ্রীনগর পরিদর্শনের সেরা সময় হিসাবে বিবেচিত হয়।
শ্রীনগর, পশ্চিম কাশ্মিরে ঝিলম নদীর তীর বরাবর অবস্থিত। এটি হল জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।
পৌঁছানোর উপায় :
বিমান মাধ্যমে
শ্রীনগর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি, শ্রীনগর থেকে প্রায় 11 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিমানবন্দর থেকে শহরটিতে গাড়ির মাধ্যমে পৌঁছাতে প্রায় 20 মিনিট সময় লাগে। এখানে বেশ কিছু বিমান রয়েছে যেগুলি এই বিমানবন্দর থেকে ভারত তথা আন্তর্জাতিক সমস্ত প্রধান শহর ও গন্তব্যস্থলগুলির মধ্যে পরিচালিত হয়।
রেল মাধ্যমে
শ্রীনগর রেলওয়ে স্টেশন কাশ্মীর রেলওয়ে বরাবর অবস্থিত যা শ্রীনগরকে বারামূলা, অনন্তনাগ ও কাজীগুন্দের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এটা এই মুহূর্তে প্রধান ভারতীয় রেলওয়ে সংযোগের সাথে সংযুক্ত নয় তবে 2017 সালে এটি উত্থাপিত হবে। বর্তমানে যেটি ভারতীয় রেলওয়ে সংযোগের সাথে সংযুক্ত রয়েছে, সেই নিকটবর্তী প্রধান রেলওয়ে স্টেশনটি হল জম্মু-তাওয়াই, যা প্রায় 300 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে শ্রীনগর পৌঁছাতে, আপনার জন্য ক্যাব অপেক্ষা করে থাকে। এই ভ্রমণে সাধারণত সাত ঘন্টারও বেশি সময় লাগে।
সড়ক মাধ্যমে
যেহেতু শ্রীনগর, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী, সেহেতু এটি সড়ক মাধ্যমে দেশের বাকি অন্যান্য অংশের সাথে সু-সংযুক্ত রয়েছে। 1A-নং জাতীয় সড়ক ও 1D-নং জাতীয় সড়ক, শহরটিকে যথাক্রমে জলন্ধর ও লেহ-র সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে।
* সর্বশেষ সংযোজন : August 31, 2015